কুরবানীর হাকীকত বা তথ্য
'কুরবানী' শব্দটা আসলে “কিরবানুন' শব্দ থেকে নেয়া হয়েছে। কিরবান বলা হয় এমন বস্তুকে যা আল্লাহ্ তায়ালার নৈকট্য লাভের মাধ্যম বা উসিলা হয়।
অর্থাৎ প্রত্যেক নেক আমল যা আল্লাহপাকের নৈকট্য ও রহমত অর্জন করে সেটা জন্তু যবাই করার মাধ্যমেই হোক বা দান-সাদকা দ্বারা হোক। কিন্তু সাধারণের মধ্যে 'কুরবান' শব্দটি যবাইর জন্যই ব্যবহৃত হয় ।
(এছাড়া কুরআন মাজীদে প্রায়ই এ শব্দ দ্বারা জন্তর মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন বুঝান হয়েছে। যেমন (-সুরা (মায়িদা ২৭ এ)
সুতরাং শরীয়তের পরিভাষায় কুরবানী হলো : একমাত্র আল্লাহ্ তায়ালার সন্তুষ্টি ও নৈকট্য লাভের জন্য নির্দিষ্ট সময়ে, নির্দিষ্ট ব্যক্তির, নির্দিষ্ট জানোয়ার যবাই করা।
অতএব কেউ যদি শুধু গোশত খাওয়ার নিয়তে কুরবানী করে বা বিবাহ শাদীতে অগণিত রুসুমের পদ্ধতিতে কুরবানী করে অথবা মনের ধারণা যে, জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই বাপ-দাদাদেরকে বকরা ঈদের কুরবানী করতে দেখে আসছি; চলো আমরাও কুরবানী দেই, অথবা পাড়া-প্রতিবেশীদের বিদ্ধূপ থেকে বাচার জন্য বা লোক দেখানোর জন্য যবাইয়ের জযবা একমাত্র আল্লাহর জন্য না হওয়া পর্যস্ত কুরবানী হতে পারে না এবং এতদভিন্ন সে কোনো সাওয়াবের আশাও করতে পারে না।
কুরবানীর কতিপয় ফাযায়িল
১. হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর রাধিয়াল্লাহু আনহু থেকে হাদীস বর্ণিত আছে যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনা মুনাওয়ারায় দশ বছর অবস্থান করেছেন, আর প্রতি বছরই কুরবানী দিয়েছেন । আর একটি হাদীস- "হযরত বারা রাষিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত রয়েছে যে, একবার বকরা ঈদের দিন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবাদেরকে সাথে নিয়ে মদীনার কবরস্থান জান্নাতুল বাকী অভিমুখে চললেন । সেখানে প্রথমে মাঠে ঈদের নামায আদায় করেন। তারপর সকলকে সম্বোধন করে বললেন, “আজ আমাদের প্রথম কাজ ছিল নামায পড়া, তারপরের কর্তব্য হলো কুরবানী করা । যেব্যক্তি এরূপ আমল করল সে আমার তরীকার ওপরই থাকবে । আর যে ব্যক্তি নামাযের পূর্বেই কুরবানী করলো তার কুরবানী সঠিক হয়নি; বরং তার কুরবানী শুধু গোশ্ত খাবার জন্যই হলো; সাওয়াবের সাথে এর কোনো সম্পর্ক থাকল না। আর কুরবানী নিছক গোশত খাওয়া বা খাওয়ানোর নাম নয়, বরং ইহা শরীয়তের একটি বিধান ।
যার আনুগত ও পালন করা জরুরী। এতে হযরত ইব্রাহীম (আঃ) এর স্মৃতি জীবন্ত ও প্রাণবন্ত এবং মুসলমানদের আত্মত্যাগের জযবা সৃষ্টি হয়ে থাকে ।
২. হযরত রাসুল কারীম (সাঃ) ইরশাদ করেছেন কুরবানীর দিন কুরবানী করার চেয়ে প্রিয় ইবাদাত আল্লাহর নিকট আর কিছুই নেই। কুরবানীর দিনে এটিই সর্বশ্রেষ্ঠ সাওয়াবের কাজ । আর কুরবানী করার মুহূর্তে রক্তের ফৌটা মাটিতে পড়ার পূর্বেই আল্লাহর নিকট কুরবানী কবুল হয়ে যায় । তাই প্রাণ খুলে তোমরা কুরবানী করো । এর চেয়ে বড় সাওয়াব কী হতে পারে? এক কুরবানীর দ্বারাই লাখ-লাখ নেকী মিলে যায়। যদি কেবলমাত্র ভেড়ার পশমও কোনো. লোক সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যস্ত গণনা করে তাহলেও সে ব্যর্থ হবে। সুতরাং চিন্তার বিষয় কুরবানীর ফযীলত এত বেশি ।
৩. হযরত যাইদ বিন আরকাম রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত । তিনি বলেন যে, সাহাবায়ে কিরাম নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! এই কুরবানী প্রথাটা কী? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, এটা তোমাদের পিতা হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম-এর সুন্নাত। সাহাবায়ে কিরাম পুনরায় জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! এতে আমাদের কী লাভ রয়েছে? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন যে, কুরবানীর পশুর প্রত্যেকটা চুলের পরিবর্তে এক নেকী পাওয়া যাবে। সাহাবায়ে কিরাম আবার জিজ্ঞেস করলেন, যে সমস্ত পশুর মধ্যে পশম রয়েছে, ওইগুলোর মধ্যে কি সাওয়াব হবে? নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন যে, ওইগুলোতেও প্রতিটি পশমের বদলে একটি করে নেকী পাওয়া যাবে। (ইবনে মাজাহ)
৪. একদা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত ফাতিমা রাজিয়াল্লাহ আনহা ডেকে ইরশাদ করেন, হে ফাতিমা! তুমি তোমার কুরবানীর জন্তুর নিকট যাও । কেননা কুরবানীর জন্ত যবাই করার পর রক্তের প্রথম ফোটা মাটিতে পড়ার সাথে সাথে তোমার যাবতীয় গুনাহ মাফ হয়ে যাবে। হযরত ফাতিমা রাষযা্লাহু আনহু জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! এটা কি শুধু আমার জন্যে? রাহমাতুললিল আলামীন জবাব দিলেন, এটা আমাদের জন্যে ও সকল মুসলমানদের জন্যে । (তারগীব)
৫. হযরত আয়িশা রাজিআল্লাহু আনহা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করেন যে, করজ করে কুরবানী করব কি-না? নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, হ্যা, কর । আল্লাহ তায়ালা খণ পরিশোধের ব্যবস্থা করে দেবেন। (দারেকুতনী ২৭৭ : ৪)
৬. নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, তোমরা মোটা-তাজা পশুর কুরবানী কর। কারণ এটা পুলসিরাতে তোমাদের সাওয়ারী হবে । (কোনযুল উম্মাল)
৭. হযরত আবু হুরাইরা রাধিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি সমর্থ থাকা সত্ত্বেও কুরবানী না করে, সে যেন আমার ঈদগাহের নিকট না যায় । (ইবনে মাজাহ ২২৬,মুসতাদরা ২ : ৩৮৭)
৮. হযরত আয়িশা রাজিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত । নবী কারীম সাল্লাল্লাহু লাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, কুরবানীর দিন কুরবানীর পশুর যবাই করা থেকে উত্তম আর কোনো ইবাদাত নেই । জন্তুটি কিয়ামতের দিবসে তার শিং, খুরা এবং তার পশম নিয়ে হাযির হবে । (এগুলো তার জন্যে বড় আকারের সাওয়াবের কারণ হবে) কুরবানীর জন্তরর রক্ত মাটিতে পড়ার পূর্বেই আল্লাহ তায়ালার দরবারে কবুল হয়ে যায় । অতএব তোমরা আনন্দের সাথে কুরবানী কর । (ইবনে মাজাহ২২৬, তিরমিযী ১৮০/১)
৯. আর এক হাদীসে এসেছে, পশুর রক্তের প্রথম ফোটা মাটিতে পড়ার পূর্বেই কুরবানীদাতার গত জীবনের সমস্ত গুনাহ মাফ হয়ে যায় ।
১০. অন্য. এক হাদীসে এসেছে, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি কুরবানী করবে, সে পশুর প্রতিটি পশমের পরিবর্তে একটি করে নেকী পাবে । (তিরমিযী ১৮০/১)
১১. হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর রাজিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত । তিনি বলেন যে, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনার দশ বছর যিন্দিগীর প্রতিটি বছরই কুরবানী করেছেন । (তিরমিযী ১৮১/১)
১২. হযরত উম্মে সালমা রাধিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তির নিকট কুরবানীর পশু রয়েছে এবং সে কুরবানী করতে মনস্থ করেছে, যিলহাজ মাসের চাদ দেখা দিলে কুরবানী না করা পর্যস্ত সে যেন নিজের চুল এবং নখ না কাটে । (মুসলিম ১৬০/২)
১৩, জনৈক সাহাবী নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! এক ব্যক্তি দুধ খাওয়ার জন্যে আমাকে একটি উট দিয়েছে। আমি কি উহা. দ্বারা কুরবানী করব? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে নিষেধ করলেন এবং বললেন, তবে তুমি নখ, চুল ইত্যাদি কাট। এটাও তোমার জন্য আল্লাহর দরবারে পূর্ন কুরবানী। এই বলে রাহমাতুললিল আলামীন গরীব সাহাবীকে সুসংবাদ দিলেন । (দারে কৃতনী ২০২/৪)
উত্তম দীনী দাবি হলো, কুরবানী ওয়াজিব না হলেও অসংখ্য সাওয়াবের আশায় কুরবানী করা । এ সুযোগ অতিবাহিত হয়ে গেলে সহজে এরূপ নেকী অর্জন করা সম্ভব নয় । আর আল্লাহপাক যাদেরকে সম্পদ দিয়েছেন তাদের উচিৎ রূহের ওপর কুরবানীর মাধ্যমে সাওয়াব পৌছান।
পবিত্র কুরআন কারীমে এ ব্যাপারে হুকুম রয়েছে “হে নবী আপনি নিজ প্রতিপালকের জন্যে নামাজ আদায় করুন এবং কুরবানী করুন।”
লেখকঃ -মূফতি হযরত মোহাম্মদ ইদরীস (প্রাক্তন মঈনে মুফতী দারুল উলুম দেওবন্দ ভারত)
কিতাবের নাম-কোরবানীর ইতিহাস এবং উহার মাসায়েল ফাজায়েল