প্রযুক্তি ও বৈজ্ঞানিক অগ্রগতিতে মুসলিম দেশগুলাে পেছনে পড়ে যাওয়ায় পাশ্চাত্য তাদের ভাগ্য নিয়ন্তা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ ধরনের পরিস্থিতি কোনাে মুসলমানের কাছে কাম্য হতে পারে না। আমরা এমন এক যুগে বসবাস করছি যেখানে একটি মুসলিম শিশু মুসলমানদের দুর্দিন ছাড়া আর কিছু দেখছে না। শুধু শিশু নয়, আবালবৃদ্ধবনিতা সবার মধ্যে এমন একটি ধারণা কাজ করছে যে, বিজ্ঞান মানেই ইউরােপ আর আমেরিকা। তাদের কাছ থেকে আমাদের জ্ঞান বিজ্ঞান শিখতে হবে। কিন্তু আমাদের। অনেকেই জানে না যে, মুসলমানরাই আধুনিক বিজ্ঞানের জন্মদাতা। আজকের এ অধঃপতিত মুসলমানদের পূর্বপুরুষেরা কয়েক শতাব্দী পর্যন্ত বিশ্বে জ্ঞানের আলাে ছড়িয়েছে। বিশ্ব সভ্যতা মুসলমানদের কাছে ঋণী। মুসলমানরাই বিশ্ব সভ্যতাকে রক্ষা করেছে। এ ব্যাপারে মুসলিম ঐতিহাসিক মােহাইনি মােহামেদের একটি উক্তি উল্লেখযোগ্য।


মােহাইমিনি তার ‘গ্রেট মুসলিম ম্যাথমেটিশিয়ান শিরােনামে গ্রন্থের ৩ নম্বর পৃষ্ঠায় লিখেছেন, ‘In the seventh century, Western Europe was declining while the Byzantine and Persian empires were manifestly bent upon mutual destruction. Likewise, India was greatly divided. However, China was steadily expanding, the Turkish in central Asia were disposed to work in an accord with China. During this period, the world was saved by the rise of the Islamic civilization.





অর্থাৎ সপ্তম শতাব্দীতে পশ্চিম ইউরোপের পতন ঘটছিল। অন্যদিকে বাইজান্টাইন ও পারস্য সাম্রাজ্য একে অন্যের ধ্বংস সাধনে ছিল সুস্পষ্টরূপে বদ্ধপরিকর। একইভাবে ভারত ছিল মারাত্মকভাবে দ্বিধাবিভক্ত। তবে দৃঢ়তার সঙ্গে চীনের সম্প্রসারণ ঘটছিল। মধ্য এশিয়ায় তুর্কিরা চীনের সঙ্গে একটি সমঝোতার ভিত্তিতে কাজ করতে আগ্রহী ছিল। এ সময় ইসলামী সভ্যতার উত্থানে বিশ্ব রক্ষা পায়। মুসলমানদের অবস্থা আজকের মতাে এত শােচনীয় ছিল না। তারা ছিল একসময় বিশ্বের প্রভু। অতীত নিয়ে একটি মুসলিম শিশু গর্ব করতে পারে। ইউরােপ ও আমেরিকাকে লক্ষ্য করে বুক ফুলিয়ে সে বলতে পারে, আমি তােমাদের মতাে ছিলাম। জ্ঞান বিজ্ঞানে আমরা তােমাদের পেছনে নই। এমন কথা বলার আগে তাকে জানতে হবে তার নিজের পরিচয়। ইসলামের স্বর্ণযুগের ইতিহাস প্রতিটি মুসলিম শিশু ও তার অভিভাবককে হীনমন্যতা থেকে রক্ষা করতে পারে। এবার এ মহিমান্বিত যুগের বিভিন্ন দিক ও বৈশিষ্ট্য নিয়ে আলােচনা করা যাক।







স্বর্ণযুগের আড়াল করা অভিসন্ধি





৭৫০ থেকে ১২৫৮ সাল পর্যন্ত সময় ইসলামের স্বর্ণযুগ বা ইসলামী রেনেসাঁ হিসাবে পরিচিত। এই আলােকিত যুগ আধুনিক বৈজ্ঞানিক যুগের অগ্রদূত হিসাবে কাজ করেছে। একটি গভীর চক্রান্ত থেকে মধ্যযুগকে অন্ধকার ও বর্বর যুগ হিসাবে আখ্যা দেয়া হচ্ছে। একইসঙ্গে বিজ্ঞানময় ধর্ম ইসলামকে জ্ঞান বিজ্ঞান ও প্রগতির পথে একটি অন্তরায় হিসাবে বিবেচনা করা হচ্ছে। কিন্তু চাইলেই সব পারা যায় না। ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে, মধ্যযুগে মুসলমানদের অগ্রগতির পেছনে ইসলাম ছিল মূল চালিকাশক্তি। স্বর্ণযুগে মুসলমানরাই ছিল পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ জাতি। শুধু বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি নয়; অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামরিক ও সংস্কৃতিতে মুসলমানরা ছিল অপ্রতিদ্বন্দ্বী। এ সত্য আড়াল করার জন্য মধ্যযুগকে অন্ধকার যুগ হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়। এ যুগের প্রতি ইতিবাচক ধারণা পােষণ করার মানে হলাে বিজ্ঞানে মুসলমানদের শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করে নেয়া। মুসলমানদের বিরুদ্ধে ক্রুসেড পরিচালনাকারীদের পরবর্তী প্রজন্ম অত্যন্ত সুচিন্তিতভাবে মধ্যযুগের সত্যিকার ইতিহাস বিকৃত করার চেষ্টা করছে। অধ্যাপক জি. সারটন অকপটে তা স্বীকার করেছেন।


তিনি ইন্ট্রডাকশন টু দ্য হিস্টরি অব সায়েন্স’-এ লিখেছেন, ‘To sum up, medievalists have given us an entirely false idea of the scientific thought of the Middle Ages because of their insistance upon the least progressive elements and their almost exclusive devotion to Western thought; when the greatest achievements were accomplished by Easterners Thus did they succeed not in destroying the popular conception of the Middle Ages as Dark Ages’. But on the contrary in reinforcing it. The Middle Ages were dark indeed when most historians showed us only (with the exception of Art) the darkest side; these Ages were never so dark as our ignorance of them.


অর্থাৎ সংক্ষেপে বলতে গেলে অত্যন্ত দুর্বল সূত্রের ওপর জোর দেয়ায় এবং পাশ্চাত্য ধ্যান ধারণার প্রতি একান্তভাবে অনুগত থাকায় ইতিহাস বিশারদগণ মধ্যযুগের বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারা সম্পর্কে আমাদেরকে পুরােপুরি মিথ্যা ধারণা দিয়েছেন। মধ্যযুগেই প্রাচ্যবাসীরা শ্রেষ্ঠতম অগ্রগতি অর্জন করেছিল। ইতিহাস বিশারদগণ মধ্যযুগের একটি অন্ধকার যুগ হিসাবে আখ্যায়িত করার প্রচলিত ধারণা বাতিল করার পরিবর্তে বরং তারা এ কারণে আরাে জোরালাে করতে সফল হয়েছেন। বস্তুতপক্ষে মধ্যযুগ ছিল অন্ধকার। তবে অধিকাংশ ঐতিহাসিক আমাদের কাছে এ সময়ের কেবলমাত্র অন্ধকারময় দিকটিই তুলে ধরেছেন (শিল্প হলাে একমাত্র ব্যতিক্রম)। এ যুগ কখনো আমাদের অজ্ঞতার চেয়ে বেশি অন্ধকার ছিল না।


অধ্যাপক জি. সারটন একই গ্রন্থে মুসলিম বিজ্ঞানীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে আরাে লিখেছেন, It will suffice here to evoke a few glorious names without contemporary equivalents in the West: Jabir ibn Hayyan, al-Kindi, al Khwarizmi, al-Fargani, al-Razi, Thabit ibn Qurra, al-Battani, Hunain ibn Ishaq, al-Farabi. Ibrahim ibn Sinan, al-Masudi, al-Tabari, Abul Wafa. Ali ibn Abbas, Abul Qasim, Ibn al-Jazzari, al-Biruni, Ibn Sina, Ibn Yunus, al Kashi, Ibn al-Haitham, Ali Ibn Isa al-Ghazali, al-Zarqab, Omar Khayyam. A magnificent array of names which it would not be difficult to extend. If anyone tells you that the Middle Ages were scientifically sterile, just quote these name to him, all of whom flourished within a short period, 750 to 1100 A.d.’









অর্থাৎ এখানে মুষ্টিমেয় কিছু নাম উল্লেখ করাই যথেষ্ট হবে। সমসাময়িককালে পাশ্চাত্যে তাদের সমতুল্য কেউ ছিল না। তারা হলেন: জাবির ইবনে হাইয়ান, আল কিন্দি, আল-খাওয়ারিজমি, আল-ফারগানি, আল-রাজি, ছাবেত ইবনে কোরা, আল বাত্তানি, হুনায়ন ইবনে ইসহাক, আল-ফারাবি, ইব্রাহিম ইবনে সিনান, আল-মাসুদি, আল তাবারি, আবুল ওয়াফা, আলী ইবনে আব্বাস, আবুল কাসিম, ইবনে আল-জাজারি, আল বেরুনি, ইবনে সিনা, ইবনে ইউনূস, আল-কাশি, ইবনে আল-হাইসাম, আলী ইবনে ইসা আল-গাজালি, আল-জারকাব, ওমর খৈয়াম। গৌরবােজ্জ্বল নামের তালিকা দীর্ঘ করা মােটেও কঠিন হবে না। যদি কেউ আপনার সামনে উচ্চারণ করে যে, মধ্যযুগ ছিল বৈজ্ঞানিক দিক থেকে অনুর্বর তাহলে তার কাছে এসব নাম উল্লেখ করুন। তাদের সবাই ৭৫০ থেকে ১১০০ সাল পর্যন্ত একটি সংক্ষিপ্ত সময়ে সমৃদ্ধি লাভ করেছিলেন।





পদার্থ বিজ্ঞানে নােবেল বিজয়ী পাকিস্তানি পদার্থ বিজ্ঞানী ড, আবদুস সালাম, কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামী বিজ্ঞানের অধ্যাপক জর্জ সালিবা এবং ঐতিহাসিক জন, এম, হবসন বলেছেন, মধ্যযুগে মুসলিম বৈজ্ঞানিক বিপ্লব ঘটেছিল। ফরাসি প্রত্নতত্ত্ববিদ রবার্ট স্টিফেন ব্রিফল্ট ‘দ্য মেকিং অব হিউমেনিটি’ (The Making of Humanity) শিরােনামে বইয়ে ইসলামী বিজ্ঞানকে আধুনিক বিজ্ঞানের ভিত্তি হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন। আমেরিকান দার্শনিক উইল ডুরান্ট, আমেরিকান মেডিকেল হিস্টরিয়ান ফিল্ডিং হাডসন গ্যারিসন, ইরানি দার্শনিক ও ঐতিহাসিক হােসেন নাসির এবং ব্রিটিশ-আমেরিকান ঐতিহাসিক বার্নার্ড লুই-ও অনুরূপ মতামত ব্যক্ত করেছেন। তাদের মতে, মুসলিম বিজ্ঞানীরা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে অবদান রাখার মধ্য দিয়ে গবেষণামূলক বিজ্ঞানের ভিত্তিস্থাপন করেছেন।


চলমান…


– সাহাদত হোসেন খান





মূল সংবাদটি পড়তে এখানে ক্লিক করুন